Subscribe:

বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলে কেন উধাও হয়ে যায় জাহাজ ও প্লেন? ফাঁস হল রহস্য


আটলান্টিক মহাসাগরে প্রায় ৫ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে বিস্তৃত বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল পৃথিবীর সবচেয়ে রহস্যময় অঞ্চলগুলির একটি। বলা হয়, এখনও পর্যন্ত প্রায় ৭৫টি এরোপ্লেন এবং একশোর বেশি জাহাজ এই অঞ্চল পার হতে গিয়ে রহস্যময়ভাবে উধাও হয়ে গিয়েছে। সেই থেকে এই অঞ্চলকে কেন্দ্র করে নানা কল্পনা দানা বেঁধেছে। কেউ বলেছেন, ওই অঞ্চলে আসলে বাসা বেঁধে রয়েছে ভিনগ্রহের প্রাণীরা, কেউ আবার মনে করেছেন, আটলান্টিকের গভীরে রয়ে গিয়েছে কোনও লুপ্ত সাম্রাজ্য। বলা বাহুল্য, এই সমস্ত তত্ত্বের কোনওটিই খুব বিজ্ঞানসম্মত নয়। কিন্তু এবার খোদ বিজ্ঞানীরাই এই রহস্য ভেদ করার লক্ষ্যে এক নতুন তত্ত্ব দাঁড় করিয়েছেন।
একদল বিজ্ঞানী মনে করছেন, এই অঞ্চলে স্থায়ী হয়ে থাকা একটি ষড়ভুজাকার মেঘস্তরই জাহাজ ও এরোপ্লেন লোপাট হয়ে যাওয়ার নেপথ্যে ক্রিয়াশীল। বিজ্ঞানীদের দাবি, এই ষড়ভুজাকার মেঘস্তর ‘এয়ার বম্ব’ তৈরি করে। যার ফলে বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের আবহাওয়া সর্বদাই অত্যন্ত খারাপ হয়ে থাকে। আর এই খারাপ আবহাওয়ার শিকার হয়েই পথভ্রষ্ট হয়ে পড়ে জাহাজ ও এরোপ্লেন, এবং শেষমেষ ভেঙে পড়ে তলিয়ে যায় সমুদ্রের গর্ভে।
বিজ্ঞানীদলের অন্তর্গত আবহবিদ র‌্যান্ডি সারভেনি সংবাদমাধ্যমকে বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বলেন, এই ধরনের এয়ার বম্ব আসলে মাইক্রোবার্স্ট নামের উপাদান নিয়ে গড়ে ওঠে। এর প্রভাবে মেঘ থেকে প্রবল বেগে নীচের দিকে হাওয়া নেমে আসে। এই হাওয়ার বেগ ১৭০ মাইল প্রতি ঘন্টার কাছাকাছি হতে পারে। এই তীব্র গতিসম্পন্ন হাওয়া নীচে নেমে এসে সমুদ্রপৃষ্ঠে ধাক্কা খেয়ে চতুর্দিকে ছিটকে পড়ে। এর ফলে তীব্র গতির হাওয়ার একটি আবর্ত তৈরি হয় বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলে। এই আবর্তেরই শিকার হয় জাহাজ ও এরোপ্লেনগুলি। নাসার উপগ্রহ চিত্রে নাকি এই ছ’কোণা মেঘস্তরের ছবি ধরা পড়েছে বলে দাবি সারভেনির।
বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের রহস্যের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা অবশ্য আগেও দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। এই বছরের মার্চ মাসেই একদল বিজ্ঞানী দাবি করেছিলেন, বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলে দেড়শো ফুট সমুদ্রগর্ভে নিহিত এবং প্রায় দেড় মাইল বিস্তৃত একটি আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ থেকে ক্রমাগত যে বিস্ফোরণ ঘটে তার প্রভাবেই এরোপ্লেন ও জাহাজ এই অঞ্চল পার হতে গিয়ে একেবারে ধ্বংসের সম্মুখীন হয়। এবারে সারভেনি ও তাঁর সঙ্গীরা অন্য রকম তত্ত্ব খাড়া করলেন। এই তত্ত্ব কতটা যৌক্তিক ভিত্তি পায়, সেটাই এখন দেখার।

এ দেশের মানুষ আমাকে ভোলেনি : রাজ্জাক


আমরা যখন কথা বলছি বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের খ্যাতিমান এই তারকার সঙ্গে, তখন ঘুরেফিরে সব কথাই এসে পৌঁছে যাচ্ছে চলচ্চিত্রের ভালো-মন্দের প্রসঙ্গে। রাজ্জাক যে আপাদমস্তক একজন চলচ্চিত্রের মানুষ, সেটাই বোঝা যাচ্ছে পরিষ্কার। কেমন লাগে এই বয়সে, কী ভাবেন এ সময়টাতে?—এমন একটা প্রশ্ন দিয়েই শুরু করি আলাপ। ‘ইচ্ছে ছিল আমরণ চলচ্চিত্রে কাজ করে যাব।’ বললেন রাজ্জাক। ‘আমার খুব চাওয়া, চলচ্চিত্রে কাজ করতে করতেই কোনো এক সময় আমার মৃত্যু হবে। কিন্তু আমি খুব কষ্ট পাই, বুঝলে! আমাদের কী জমজমাট ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিটা ছিল! এই ইন্ডাস্ট্রিতে আছি বলে গর্ব করতাম। আর আজ কী অবস্থা!’ ধরুন, আপনাকে যদি চলচ্চিত্র জগতের একজন মানুষের নাম বলতে বলা হয়, যাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি আপনাকে এ জগতের জন্য তৈরি করেছে, তবে কার নাম করবেন? বিন্দুমাত্র না ভেবে রাজ্জাক বললেন, ‘জহির রায়হান। তিনি আমাকে আশ্বাস দিয়েছিলেন। আমি তখন চলচ্চিত্র জগতে বারবার রিফিউজড হচ্ছি। কেউ আমাকে নিয়ে ভাবছে না। তখন তিনিই একমাত্র মানুষ, যিনি আমাকে বলেছিলেন, “আমি আপনাকে ব্রেক দেব।” তখন তিনি “বাহানা” ছবিটি করছিলেন। সেটা শেষ হলে “হাজার বছর ধরে” করবেন ভেবেছিলেন। কিন্তু তা আর করা হয়নি। তবে আমাকে স্নেহ দিয়ে, উপদেশ দিয়ে এই জগতের উপযোগী করে তুলেছিলেন তিনি।’ ঘর থেকে তো আপনাকে কোনো সমস্যায় পড়তে হয়নি কখনো... হাসলেন রাজ্জাক। বললেন, ‘এ কথাটাও আমি বলতে চাইছিলাম। যখন একটু নাম হলো, যখন মন খুলে কাজ করার কথা, তখন পাশে পেয়েছি স্ত্রী লক্ষ্মীকে। তিনি আমাকে একটা নির্ঝঞ্ঝাট জীবন দিয়েছেন। তখন তো বুঝতেই পারছ, নাম হলে নারীমহলে সাড়া পড়ে যায়। সেগুলো সামলে নিতে পারতাম না, যদি না লক্ষ্মী থাকতেন পাশে। আমার এত দূর আসার পেছনে জহির রায়হান আর লক্ষ্মীর সাহায্য রয়েছে অনেকখানি।’ আপনি জনপ্রিয় মানুষ, রাজনীতির সঙ্গে নিজেকে জড়ানোর কথা ভাবেননি কখনো? ‘আমার জগৎ, ধ্যানজ্ঞান সবই ছিল চলচ্চিত্র ও নাটকে অভিনয়কে কেন্দ্র করে। অভিনয়টাই ছিল রক্তের ভেতর। হ্যাঁ, হয়তো রাজনীতি করতে পারতাম, এমপি-মিনিস্টার হতে পারতাম। কিন্তু ওটা তো আমার স্বপ্ন বা পেশা নয়। আমি স্বপ্ন দেখেছি নায়ক হব, ভালো অভিনেতা হব। নিজের অন্তরে যা বসাতে পারব না, সেটা পেশা হিসেবে গ্রহণ করব কেন? আমার তো পারিবারিক রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড নেই। আমি কেন রাজনীতি করব?’ চলচ্চিত্রের তো এখন দৈন্যদশা। বাঁচার উপায় কিছু দেখছেন? ‘যখন আমরা চলচ্চিত্রে অভিনয় করা শুরু করেছি, তখন কেউ টাকার দিকে তাকাইনি। ছবি হিট করলেও পয়সা চাইনি। দুবেলা ডাল-ভাত খেতে পারলেই মনে হতো শান্তিতে আছি। একসময় বাঙালি পরিচালকেরা বাংলা ছবি ফ্লপ হয় বলে উর্দু ছবি বানাতে শুরু করলেন। আমরা প্রতিজ্ঞা করলাম, বাংলা চলচ্চিত্রশিল্পটাকে বাঁচাব। পরিচালক-অভিনয়শিল্পী-গায়ক-সংগীত পরিচালক—সবাই মিলে আমরা সেই চেষ্টা চালিয়ে গেছি। তখন প্রযোজকের সঙ্গে প্রযোজকের ছিল ভালো সম্পর্ক। এখন তো প্রযোজক-প্রযোজক দূরের কথা, শিল্পীর সঙ্গে শিল্পীরই সুসম্পর্ক নেই। সে সময় কী অসাধারণ সব ছবি তৈরি হয়েছে! ‘আগুন নিয়ে খেলা’র পর অনেকেই বাংলা ছবির দিকে ঝুঁকলেন। নির্মাণ করা হলো নীল আকাশের নিচে। বাংলা চলচ্চিত্রকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সে কী সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টা!’ এখন তা নেই কেন? ‘কী করে থাকবে? কারও সঙ্গে কারও সুসম্পর্ক নেই। সবাই টাকার পেছনে দৌড়াচ্ছে। শিল্প নির্মাণ করার সময় কোথায়? অবস্থা কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে, জানো? সিনেমা হলের মেশিনের ভাড়াটাও এখন দিতে হচ্ছে প্রযোজককে। অবস্থা এমন হলে চলচ্চিত্রশিল্প বাঁচবে কী করে? এফডিসির কী দৈন্যদশা! সমিতি তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন, তারা চা খাচ্ছে, পিকনিক করছে। কিন্তু চলচ্চিত্রটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াচ্ছে, সে খোঁজ রাখছে না কেউ!’ পঁচাত্তরের দিকে হাঁটা শুরু করার আগমুহূর্তে নিজের ভাবনার কথা বলুন। ‘এত সব কষ্টের মধ্যেও আনন্দে আছি। আমি যখন “রাজ্জাক” হিসেবে দর্শকের মনে জন্মগ্রহণ করলাম, তখন এ দেশের মানুষ ছিল সাড়ে সাত কোটি। এখন প্রায় ১৭ কোটি। এখন আমি ১৭ কোটি মানুষের দোয়া-আশীর্বাদ পাচ্ছি। আমার সবচেয়ে ভালো লাগছে এই ভেবে যে এ দেশের মানুষ আমাকে ভোলেনি।’

সুত্র :প্রথম আলো

এক নজরে রাজ্জাক



নাম: আবদুর রাজ্জাক।
উপাধি: নায়করাজ (উপাধি দিয়েছিলেন চিত্রালী সম্পাদক আহমদ জামান চৌধুরী)
জন্ম: ২৩ জানুয়ারি, ১৯৪২
জন্মস্থান: নাকতলা, দক্ষিণ কলকাতা, ভারত
জাতীয়তা: বাংলাদেশি
বাবা: আকবর হোসেন
মা: নিসারুননেছা
স্ত্রী: খাইরুন্নেছা (ভালোবেসে লক্ষ্মী বলে ডাকতেন)
সন্তান: বাপ্পারাজ (রেজাউল করিম), নাসরিন পাশা শম্পা, রওশন হোসেন বাপ্পি, আফরিন আলম ময়না, খালিদ হোসেইন সম্রাট
পেশা: অভিনেতা, প্রযোজক, পরিচালক
অভিনয়ের শুরু: কলকাতার খানপুর হাইস্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে পড়াকালীন স্বরসতী পূজায় মঞ্চ নাটকে। গেম টিচার রবীন্দ্রনাথ চক্রবর্তী তাঁকে বেছে নিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় চরিত্রে। প্রথম অভিনীত নাটক ‘বিদ্রোহী’
সিনেমায় প্রবেশ: কলেজজীবনে ‘রতন লাল বাঙালি’ সিনেমায় অভিনয়ের মাধ্যমে। এ ছাড়া কলকাতায় ‘পঙ্কতিলক’ ও ‘শিলালিপি’ নামে আরও দুটি সিনেমায় অভিনয় করেন
বাংলাদেশে আগমন: ১৯৬৪ সালে কলকাতায় হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার কারণে পরিবার নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন
ঢালিউডে নায়ক হিসেবে প্রথম চলচ্চিত্র: জহির রায়হানের বেহুলা
প্রথম নায়িকা: সুচন্দা
জুটি: কবরী
নায়ক হিসেবে শেষ ছবি: ১৯৯০ সাল পর্যন্ত নায়ক হিসেবে অভিনয় করেছেন। শেষ ছবি মালামতি। নায়িকা ছিলেন নূতন
নায়ক চরিত্রের বাইরে অভিনয়: ১৯৯৫ সাল থেকে
উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র: এতটুকু আশা, নীল আকাশের নিচে, জীবন থেকে নেয়া, নাচের পুতুল, পিচঢালা পথ, আবির্ভাব, দ্বীপ নেভে নাই, টাকা আনা পাই, রংবাজ, আলোর মিছিল, অশিক্ষিত, ছুটির ঘণ্টা, চন্দ্রনাথ, শুভদা, রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্ত
প্রথম পরিচালিত চলচ্চিত্র: অনন্ত প্রেম (১৯৭৭), নায়িকা চরিত্রে ছিলেন ববিতা
সর্বশেষ পরিচালিত চরিত্র: আয়না কাহিনি (২০১৪)
সর্বশেষ চলচ্চিত্র: কার্তুজ (২০১৪)
ছবির সংখ্যা: বাংলা ও উর্দু মিলিয়ে প্রায় তিন শতাধিক
পুরস্কার: পাঁচবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (সেরা অভিনেতা), মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার ২০১৪ (আজীবন সম্মাননা), বাচসাস পুরস্কার ২০০৯ (আজীবন সম্মাননা)
সুত্র :প্রথম আলো

রাজ্জাক : জীবন থেকে নেয়া

নায়করাজ রাজ্জাক ২০১৪ সালে মেরিল-প্রথম আলো আজীবন সম্মাননা পুরস্কারে ভূষিত হন। তাঁকে নিয়ে প্রথম আলোর ক্রোড়পত্র ছুটির দিনে প্রচ্ছদ প্রতিবেদন প্রকাশ করে ওই বছরের ২৬ এপ্রিল। পড়ুন সেই প্রতিবেদনটি:
হতে চেয়েছিলেন খেলোয়াড়—তুখোড় গোলরক্ষক। কিন্তু হয়ে গেলেন অভিনেতা। একসময় উপাধি পেলেন ‘নায়করাজ’। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রশিল্প যাঁদের হাত ধরে দাঁড়িয়েছে, তিনি তাঁদেরই একজন। গত শতাব্দীর ষাট-সত্তর-আশির দশকে প্রবলভাবে তিনি রুপালি পর্দায় উপস্থিত। এরপর অংশগ্রহণ কমলেও এখনো প্রবলভাবেই চলচ্চিত্রের মানুষ তিনি। এবার মেরিল-প্রথম আলো আজীবন সম্মাননা পেলেন রাজ্জাক। সাধারণ্যে এখনো তিনি নায়করাজ রাজ্জাক নামেই পরিচিত।

 ছবি বিশ্বাসের শিষ্য:
‘সিনেমায় এলেন কী করে?’ এটাই ছিল আমাদের প্রথম প্রশ্ন।
‘সিনেমায় আসব, এ রকম কোনো পরিকল্পনাই ছিল না শৈশবে। আমরা থাকতাম কলকাতায় নাকতলায়, পড়তাম খানপুর হাইস্কুলে। ছবি বিশ্বাস, কানন দেবী, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়রা থাকতেন আমাদের পাড়ায়। স্কুলে ফুটবলের নেশা পেয়ে বসেছিল। ছিলাম গোলরক্ষক। ভালো খেলতাম। আমাদের স্কুলে দুটো শিফট ছিল। সকালের শিফটে পড়ত মেয়েরা, পরের শিফটে ছেলেরা। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো স্কুলে। আমরা আবৃত্তি করতাম। ছবি বিশ্বাস বিপুল উৎসাহ নিয়ে আমাদের আবৃত্তি শেখাতেন।’
একালের পাঠকদের জন্য ছবি বিশ্বাস সম্পর্কে কয়েকটি তথ্য: কলকাতার নাটক ও চলচ্চিত্র জগতে ছবি বিশ্বাস একসময় দাপটের সঙ্গে অভিনয় করেছেন। সত্যজিৎ রায়ের কাঞ্চনজঙ্ঘা ও জলসাঘর ছবি দুটো দেখলেই কোন মাপের অভিনেতা ছিলেন তিনি, সেটা বিলক্ষণ বোঝা যাবে। সেই ছবি বিশ্বাস পাড়ার ছেলে কিশোর রাজ্জাককেও আবৃত্তি শেখাতেন।

খেলার মাঠ থেকে মঞ্চে:
আবৃত্তি, গান তো ছিলই। কিন্তু স্কুলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে এতদিন মেয়েরাই অভিনয় করত। শিক্ষক রথীন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ঠিক করলেন, ছেলেদের দিয়ে নাটক করাবেন। জোগাড় করা হলো নারী চরিত্রবর্জিত নাটক বিদ্রোহী। এবার প্রশ্ন: ‘হিরো’ হবে কে? রাজ্জাক তখন দারুণ এক ফুটবল ম্যাচে গোলপোস্ট সামলাচ্ছেন। রথীন্দ্রনাথ বললেন, ‘ওকে ধরে নিয়ে আয়!’
খেলার মাঠ থেকে ‘গ্রেপ্তার’ হলেন রাজ্জাক। করলেন অভিনয়। পরদিন স্কুলের কয়েকটা মেয়েও বলল, ‘তুই তো ভালো অভিনয় করিস!’
মেয়েদের প্রশংসা একটি কিশোরকে তো আপ্লুত করতেই পারে! ফলে অভিনয়ে মনোযোগী হলেন তিনি। পাড়ার শক্তিসংঘ ক্লাবে তখন নাটকের চর্চা হতো। শক্তিমান স্ক্রিপ্ট রাইটার জ্যোতির্ময় চক্রবর্তী ছিলেন এই ক্লাবের নাটের গুরু। তিনি নতুন ইহুদি নামে একটি নাটক লিখলেন। পূর্ব বাংলা থেকে উদ্বাস্তু হয়ে যারা পশ্চিম বাংলায় এসেছিল, তাদেরই একটি পরিবারকে নিয়ে কাহিনি। পুরো সংসারের হাল ধরে একটি কিশোর ছেলে। হকারি করে, ঠোঙা বিক্রি করে, পত্রিকা বিক্রি করে। এই চরিত্রে অভিনয় করার জন্য ডাক পড়ল রাজ্জাকের। জ্যোতির্ময় চক্রবর্তী বললেন, ‘তুই আয়।’
এ নাটকটিতেও রাজ্জাক দারুণ অভিনয় করলেন। একটু একটু করে নাটকের নেশায় পেয়ে বসল তাঁকে। আশপাশের পাড়াগুলোতেও কিশোর নায়ক চরিত্রে অভিনয় করতে থাকলেন দাপটের সঙ্গে। খেলোয়াড় হওয়ার শখ ধীরে ধীরে নির্বাসিত হলো। অভিনেতা রাজ্জাক মূর্ত হয়ে উঠল।

সপরিবারে রাজ্জাক

তরুণতীর্থ:
তরুণতীর্থ সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর সভাপতি ছিলেন ছবি বিশ্বাস। পীযূষ বোস ছিলেন নাট্যপরিচালক। এখানে নিয়মিত অভিনয় শুরু করলেন রাজ্জাক। অভিনয় করতে করতেই কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে। পরিবারের কেউ মঞ্চের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। তাই কেউই তাঁর নেশাকে স্বীকৃতি দেননি। কেবল একজনই—মেজদা আবদুল গফুর—বলেছেন, ‘আমি আছি তোর পাশে, চালিয়ে যা!’
‘মুশকিল হলো, আমাকে নিয়ে চিন্তিত পরিবারের লোকজন আমাকে এ সময় বিয়ে করতে বাধ্য করলেন। তাঁদের ধারণা ছিল, অভিনয় করতে গিয়ে আমি বুঝি দুনিয়ার মেয়েদের সঙ্গে ঘুরে বেড়াই। তাঁরা শর্ত দিলেন, নাটক করতে চাও করো, কিন্তু বিয়ে করতে হবে। অগত্যা, ১৯৬২ সালে আমি বিয়ে করলাম।’ লক্ষ্মী নামের মেয়েটি রাজ্জাকের সংসারে এল লক্ষ্মী হয়েই।

স্ত্রী মোসাম্মাত খায়রুন্নেসা লক্ষ্মীর সঙ্গে

কলকাতা থেকে ঢাকা:
‘১৯৬৪ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর ঠিক করলাম বম্বে চলে যাব। কিন্তু ওস্তাদ পীযূষ বোস বললেন, ক্যারিয়ার গড়তে হলে পূর্ব পাকিস্তানে চলে যাও। কলকাতায় আমাদের পরিবারের ব্যবসা ছিল, কারখানা ছিল। সচ্ছল ছিলাম আমরা। আমি খুব জেদি ছিলাম। ঠিক করেছিলাম, একেবারে মাইগ্রেশন করেই ঢাকায় চলে আসব। সেই ভাবনা থেকেই কিছু টাকা-পয়সা নিয়ে চলে এলাম ঢাকায়। বাপ্পা তখন আট মাসের শিশু। ঢাকার কমলাপুরে ছোট্ট একটা বাড়ি ভাড়া করলাম। রোজগার বলতে কিছু নেই। টাকা ফুরিয়ে যাচ্ছে দ্রুত। এবার শুরু হলো সত্যিকারের জীবনসংগ্রাম।
‘টেলিভিশনে সংবাদপাঠক হিসেবে অডিশন দিলাম। পাস করলাম। কিন্তু অভিনেত্রী রেশমার স্বামী জামান আলী খান বললেন, “স্টপ। তুমি অভিনেতা মানুষ। তুমি কেন খবর পড়বে?” তিনি ডিআইটিতে নিয়ে গেলেন। তখন একটি ধারাবাহিক নাটক হতো ঘরোয়া নামে। আনোয়ারা বেগম, শিমূল বিল্লাহ (এখন ইউসুফ), লালু ভাই অভিনয় করতেন। আমিও সে নাটকের লোক হয়ে গেলাম। কিন্তু সংসার তো চলে না।’

জীবন থেকে নেয়া ছবিতে সুচন্দার সঙ্গে

সংগ্রাম:
ততদিনে ফার্মগেটে একটা বাড়ি ভাড়া নিয়েছেন রাজ্জাক। হেঁটে হেঁটে ফার্মগেট থেকে ডিআইটি টেলিভিশন ভবনে যান। আট আনা, এক টাকা বাঁচে, সেটাই অনেক।
অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করলাম, রাজ্জাকের গলায় কথা আটকে যাচ্ছে। চোখে পানি। বললেন, ‘জানেন, তখন পাঁচ টাকায় এক কৌটা ড্যানো দুধ পাওয়া যেত। আমি খুব জেদি। পরিবারের কাছ থেকে আর কোনো দিন টাকা চাইনি। কিন্তু তখন টিকে থাকা ছিল খুব কঠিন। কিন্তু লক্ষ্মী ছিল পাহাড়ের মতো অটল। ও বলেছিল, চেষ্টা করো। ওর কারণেই রয়ে গেলাম। যুদ্ধ ঘোষণা করলাম, আমাকে কিছু একটা করতেই হবে।’
কাজী জহির, মুস্তাফিজ, সুভাষ দত্তদের কাছে যান রাজ্জাক। অনুরোধ করেন, ‘একটা চরিত্র যদি দেন আমাকে!’ সবাই শোনেন। রাজ্জাক বলেন, ‘নাটকের ওপর কাজ করেছি। বম্বের শশধর মুখার্জির ফিল্মালয় থেকে নয় মাসের কোর্সও করেছি। ছোটখাটো একটা পার্ট যদি দেন! হিরো হতে চাই না। চাই যেকোনো একটি চরিত্র!’ কার বউ, ১৩ নং ফেকু ওস্তাগার লেন ইত্যাদি সিনেমায় মিলতে থাকে ছোটখাটো কাজ। কিন্তু সেটা টিকে থাকার মতো যথেষ্ট কিছু নয়।

রংবাজ ছবিতে কবরীর সঙ্গে

জহিরের ডাক
জহির রায়হানের সঙ্গে যোগাযোগ হতেই জহির বলেন, ‘আপনি তো এখানকার মানুষ নন। কোত্থেকে এসেছেন?’
রাজ্জাক বলেন, ‘কলকাতার।’
ঝটপট জহির বলেন, রোববার সকালে ঘুম থেকে উঠে সোজা আমার কায়েতটুলির বাড়িতে চলে আসবেন। চুল-টুল আঁচড়াবেন না। ঘুম থেকে উঠে সোজা—বুঝেছেন?’
রাজ্জাক রোমাঞ্চিত হন। কথামতো কায়েতটুলিতে যাওয়ার পর খুশি হন জহির। বলেন, ‘আমি আপনাকে নায়কের পার্ট দেব।’
রাজ্জাক আকাশ থেকে পড়েন। আস্তে আস্তে জানতে পারেন, জহিরের নিজের লেখা উপন্যাস হাজার বছর ধরে থেকে ছবি বানাচ্ছেন তিনি। সেখানে মূল চরিত্রটি তিনি রাজ্জাককে দিতে চান। কিন্তু সে সময়ই জহিরেরও কী সব ঝামেলা হলো। ছবিটি আর করা হলো না। দিশেহারা হয়ে পড়লেন রাজ্জাক।
কেটে গেল বেশ কিছু দিন। এর মধ্যে একদিন মোহাম্মদ জাকারিয়ার সঙ্গে দেখা। সেই জাকারিয়া, যিনি শম্ভু মিত্রের বহুরূপীর সদস্য ছিলেন। বললেন, ‘জহির রায়হান আপনাকে হন্যে হয়ে খুঁজছে।’
জহির রাজ্জাককে দেখেই বলে উঠলেন, ‘আপনার বাড়ি চিনি না। কেউ ঠিকানা দিতে পারছে না! আর আপনাকে আমি হিরো করে রেখেছি!’ তখনই সাইনিং মানি বাবদ পেলেন ৫০০ টাকা। সেখানেই মিষ্টিমুখ করালেন ইউনিটের সবাইকে। বাকি টাকা লক্ষ্মীর হাতে তুলে দিয়ে বললেন, ‘আমি জহির রায়হানের ছবিতে “হিরো” হয়েছি।’
ছবিটির নাম ছিল বেহুলা। পাঁচ হাজার টাকা পেয়েছিলেন ছবিটি করে। এরপর আগুন নিয়ে খেলা করার সময় তিনি নিলেন সাত হাজার টাকা। এটা সেই সময়ের কথা বলা হচ্ছে, যখন একটি বড় মোরগ পাওয়া যেত দেড় টাকায়!

উর্দু না বাংলা/জীবন থেকে নেয়া:
ষাটের দশকটা ছিল বাঙালি জাতীয়তাবোধে জাগ্রত হওয়ার দশক। চলচ্চিত্র থেকেও উর্দুর দাপট কাটিয়ে বাংলাকে প্রতিষ্ঠিত করার দশক। রাজ্জাক ছিলেন সে আন্দোলনের একজন একনিষ্ঠ সৈনিক। বেহুলা থেকেই রাজ্জাককে চিনে নিল দর্শক। বাংলা ছবিও যে দর্শককে টেনে নিয়ে যেতে পারে সিনেমা হলে। তা প্রমাণিত হলো। প্রস্তাব পেলেও রাজ্জাক কখনো উর্দু ছবিতে অভিনয় করেননি। এরপর আগুন নিয়ে খেলা, আবির্ভাব, এতটুকু আশা, কাচ কাটা হীরা, অশ্রু দিয়ে লেখা দিয়ে পৌঁছুলেন জীবন থেকে নেয়া ছবির কাছে। ততদিনে রাজ্জাক এক নম্বর তারকা।
জহির রায়হানের জীবন থেকে নেয়া ছবিটি ঘিরে অনেক স্মৃতি রাজ্জাকের। জহির রায়হান যে রাজ্জাকের মন কতটা ছুঁয়ে আছেন, তা বোঝা গেল তাঁর চোখের জলে। বহুবার সিনেমায় চিত্রনাট্যের প্রয়োজনে কাঁদতে হয়েছে, কিন্তু এই চোখের জলে অভিনয় নেই। বুক থেকে বেরিয়ে আসা কান্না।

‘আমার কাছে মনে হয়, জীবন থেকে নেয়া ছবিটি স্বাধীনতার পূর্বঘোষণা। আমরা এফডিসির ৩ নম্বর ফ্লোরে কাজ শুরু করলাম। হঠাৎ আর্মি এসে ঘিরে ফেলল ফ্লোরটা। বলল, “ডিরেক্টর কে?” জহির ভাই বললেন, “আমি।” “অ্যাক্টর?” বললাম, “আমি।” আমাকে মূল অভিনেতা হিসেবে ভাবতেই পারছিল না ওরা। এবার আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো ক্যান্টনমেন্টে। সেখানে তিন ঘণ্টা ধরে জহির ভাইয়ের সঙ্গে তর্ক চলল ওদের। জহির ভাই বলছিলেন, “আমাকে ধরে এনেছেন কোন আইনে? ছবি হলো কি হলো না, সেটা তো সেন্সর বোর্ড দেখবে।” অনেক তর্কের পর আমরা যুদ্ধ জয় করে ফিরে এলাম। শুটিং করেছিলাম প্রভাতফেরিতে। একটি মিছিলে ঢুকেই কাজটি করতে হয়েছিল। সে এক অদ্ভুত ঘটনা। এরপর জীবন থেকে নেয়া তো ইতিহাসই হয়ে গেল।

অনন্ত প্রেম ছবিতে ববিতার সঙ্গে

স্বাধীনতার পর:
স্বাধীনতার পর ওরা ১১ জন, অবুঝ মন, রংবাজ করেছেন। এরপর আলোর মিছিল ছবিটি ছিল ব্যতিক্রমী। বাদী থেকে বেগম, মায়ার বাঁধন হয়ে তিনি পাড়ি দিলেন অনেকটা পথ—একেবারে অনন্ত প্রেম পর্যন্ত। এই ছবিটি পরিচালনাও করলেন রাজ্জাক। অগ্নিশিখা, অশিক্ষিত, ছুটির ঘণ্টা...ছবির পর ছবি করে যেতে লাগলেন। মাঝে মাঝে পরিচালনাও করলেন। বাবা কেন চাকর, মরণ নিয়ে খেলা তাঁর পরিচালনায় আরো দুটি ছবির নাম। রাজ্জাক-নির্মিত ছবিগুলো ছিল সুস্থধারার। চলচ্চিত্র জগতে যখন অপসংস্কৃতি ধীরে ধীরে বাসা বাঁধতে শুরু করল, তখনো রাজ্জাক নিরলসভাবে সুরুচিসম্পন্ন ভালো বাণিজ্যিক ছবি করে যেতে থাকলেন। এরই মধ্যে সুচন্দা, কবরী, শাবানা, ববিতা, রোজিনার সঙ্গে একের পর এক সফল জুটি উপহার দিয়ে গেলেন।

কৃতজ্ঞতা:
দীর্ঘ চলচ্চিত্রজীবনে সহশিল্পীদের কাছ থেকে যে ভালোবাসা, সহযোগিতা পেয়েছেন, তা ভুলতে পারেন না রাজ্জাক। সবচেয়ে বেশি কৃতজ্ঞতা জানালেন দর্শকদের। বললেন, ‘এ দেশের মানুষ নির্দ্বিধায়, নিঃশঙ্কচিত্তে আমাকে বছরের পর বছর ধরে যে ভালোবাসা দিয়ে গেছেন, তা আমার সবচেয়ে বড় পাওয়া। আমার মতো একজন সাধারণ নায়ককে তাঁরা “নায়করাজ” বানিয়েছেন। তাঁদের প্রতি সম্মান রেখেই আমি কাজ করি। আমি ভাগ্যবান শিল্পী। ভাগ্যবান নায়ক। পাঁচটি প্রজন্মকে ৭২ বছরের জীবনে বিনোদন দিয়ে আসতে পারছি। মাঝে মাঝে নিজেকে তৃপ্ত মনে হয়। ৫০টা বছর একটা দেশের মানুষের মনের মণিকোঠায় থাকা সহজ কথা নয়। তালি আর ফুল বড় বিপজ্জনক জিনিস!’
১৯৪২ সালের ২৩ জানুয়ারি জন্ম নেওয়া এই শিল্পীর বুক থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।

দুঃখ:
‘তৃপ্ত’ রাজ্জাক যে সব বিষয়েই তৃপ্ত, তা নয়। বললেন, ‘কী ইন্ডাস্ট্রি বানিয়েছিলাম আমরা, আর কী হয়ে গেল সেটা! কেন যেন মনে হয়, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ কমে গেছে আমাদের। এটা একেবারেই ভালো লাগে না। আমি চাই, বাংলাদেশের বাংলা চলচ্চিত্র আবার একটা উচ্চতায় পৌঁছাবে।’

রাজ্জাক একটি সুস্থধারার উন্নত রুচির চলচ্চিত্রশিল্পের স্বপ্ন দেখেন। এবং দেখতেই থাকেন।

একনজরে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার:
* কি যে করি (১৯৭৬)
* অশিক্ষিত (১৯৭৮)
* বড় ভালো লোক ছিল (১৯৮২)
* চন্দ্রনাথ (১৯৮৪)
* যোগাযোগ (১৯৮৮)
* আজীবন সম্মাননা ২০১৩
মেরিল-প্রথম আলো আজীবন সম্মাননা ২০১৪
 
সুত্র :প্রথম আলো

বাবার জন্য আপনারা দোয়া করেন: সম্রাট


কিংবদন্তি অভিনেতা নায়করাজ রাজ্জাকের জন্য সবার কাছে দোয়া চেয়েছেন ছেলে খালিদ হোসেইন সম্রাট। সোমবার সন্ধ্যায় বেসরকারি ইউনাইটেড হাসপাতালে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, আপনারা বাবার জন্য দোয়া করবেন। এখন দোয়া ছাড়া কিছু করার নেই। ভাই (বাপ্পারাজ) দেশের বাইরে। তাঁর সঙ্গে কথা বলে দাফন ও অন্যান্য বিষয়ে রাতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

সোমবার সন্ধ্যা ৬টা ১৩ মিনিটে চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় অভিনয়শিল্পী নায়করাজ রাজ্জাক ইন্তেকাল করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর।

সুত্র :প্রথম আলো

নায়করাজ রাজ্জাক আর নেই!!


চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় অভিনয়শিল্পী নায়করাজ রাজ্জাক আর নেই। আজ সোমবার সন্ধ্যা ৬টা ১৩ মিনিটে তিনি ইন্তেকাল করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর।

বেসরকারি ইউনাইটেড হাসপাতাল সূত্র জানায়, সোমবার বিকেল ৫টা ২০ মিনিটে হার্ট অ্যাটাক হওয়া অবস্থায় নায়ক রাজ্জাককে হাসপাতালে আনা হয়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সব ধরনের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। ৬টা ১৩ মিনিটে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

মৃত্যুকালে নায়করাজ স্ত্রী, সন্তানসহ অসংখ্য আত্মীয়স্বজন ও গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। ২০১৪ সালে মেরিল-প্রথম আলো আজীবন সম্মাননা পাওয়া এ অভিনেতার মৃত্যুসংবাদ শুনে তাঁকে শেষবারের মতো দেখতে হাসপাতালে ছুটে গেছেন দীর্ঘদিনের সহকর্মীরা।

১৯৬৬ সালে ‘বেহুলা’ চলচ্চিত্রে নায়ক হিসেবে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে ঢাকাই ছবিতে দর্শকনন্দিত হন কিংবদন্তি এ অভিনেতা।

নায়করাজ রাজ্জাক প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন ‘কি যে করি’ ছবিতে অভিনয় করে। পাঁচবার তিনি জাতীয় সম্মাননা পান। ২০১৩ সালের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে তিনি আজীবন সম্মাননা অর্জন করেন। এ ছাড়া বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি (বাচসাস) পুরস্কার পেয়েছেন অসংখ্যবার।

বর্তমান সময়ে চলচ্চিত্রে খুব কমই অভিনয় করছেন নায়করাজ রাজ্জাক। শুধু নায়ক হিসেবেই নয়, পরিচালক হিসেবেও বেশ সফল। ‘আয়না কাহিনী’ ছবিটি নির্মাণ করেন রাজ্জাক। নায়ক হিসেবে নায়করাজ প্রথম অভিনয় করেন জহির রায়হান পরিচালিত ‘বেহুলা’ ছবিতে। এতে তাঁর বিপরীতে ছিলেন সুচন্দা।

‘অবুঝ মন’, ‘আলোর মিছিল’ ‘ছুটির ঘণ্টা’, ‘রংবাজ’, ‘বাবা কেন চাকর’, ‘নীল আকাশের নিচে’, ‘জীবন থেকে নেওয়া’ ‘পিচঢালা পথ’, ‘অশিক্ষিত’, ‘বড় ভালো লোক ছিল’সহ অসংখ্য ছবিতে অভিনয় করা রাজ্জাক সর্বশেষ অভিনয় করেছেন ছেলে বাপ্পারাজ পরিচালিত ‘কার্তুজ’ ছবিতে।

ষাটের দশকের মাঝের দিকে রাজ্জাক চলচ্চিত্র অভিনেতা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। সত্তরের দশকেও বাংলাদেশের চলচ্চিত্রশিল্পের প্রধান অভিনেতা হিসেবে বিবেচনা করা হতো। তিনি একাধারে অভিনেতা, প্রযোজক, পরিচালক হিসেবে সুনাম অর্জন করেন।

চলচ্চিত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কেউ ডাকলে তাতে সাড়া দিতেন ‘বেহুলা’, ‘আগুন নিয়ে খেলা’, ‘এতটুকু আশা’, ‘অশ্রু দিয়ে লেখা’, ‘ওরা ১১ জন’, ‘অবুঝ মন’-এ অভিনয় করা রাজ্জাক। আমৃত্যু এই শিল্পের সঙ্গেই থাকতে চাওয়ার কথা জানিয়ে একসময় বলছিলেন, ‘আমি রাজ্জাক হয়তো অন্য কোনো চাকরি করতাম অথবা ঘুরে বেড়াতাম। কিন্তু ছোটবেলার অভিনয় প্রচেষ্টাকে আমি হারাতে দিইনি। আমি নাটক থেকে চলচ্চিত্রে এসেছি। সবাই আমাকে চিনেছে। পেয়েছি সাফল্যও। বাংলার মানুষজন আমাকে একজন অভিনয়শিল্পী হিসেবেই দেখেন ও আমাকে ভালোবাসেন। আজকে আমার যা কিছু হয়েছে, সবই এই চলচ্চিত্রশিল্পের কল্যাণে।

রাজ্জাক এ-ও বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের ছোট একটি দেশ হতে পারে, তারপরও এই দেশের একজন অভিনয়শিল্পী হিসেবে আমি গর্ববোধ করি। যাঁদের জন্য আমি রাজ্জাক হয়েছি, আমি সব সময় তাঁদের কাছাকাছি থাকতে চাই।

১৯৪২ সালের ২৩ জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন কিংবদন্তি নায়ক রাজ্জাক। সেখানেই ছোটবেলা কাটে। মঞ্চনাটকে অভিনয়ের হাতে খড়িও সেখানে।

নায়করাজের দুই ছেলে বাপ্পারাজ ও সম্রাটও চলচ্চিত্র অভিনয়শিল্পী।

রাষ্ট্রপতির শোক:
রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি অভিনেতা নায়করাজ রাজ্জাকের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। এক শোকবার্তায় রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘বাংলা চলচ্চিত্রের দর্শকপ্রিয়তা অর্জনে নায়করাজ রাজ্জাকের অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।’ রাষ্ট্রপতি আরও বলেন, বাঙালি সংস্কৃতি চলচ্চিত্রের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম স্মরণ করবে।
রাষ্ট্রপতি রাজ্জাকের রুহের মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।

প্রধানমন্ত্রীর শোক:
ঢাকাই ছবির কিংবদন্তি অভিনেতা নায়করাজ রাজ্জাকের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এক শোকবার্তায় প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতে রাজ্জাকের অবদানের কথা স্মরণ করে বলেন, ‘তাঁর মৃত্যুতে দেশের চলচ্চিত্রশিল্পের জন্য একটি অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল। তিনি ছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের উজ্জ্বল নক্ষত্র।’

শেখ হাসিনা নায়করাজের রুহের মাগফিরাত কামনা করেন এবং তাঁর শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা প্রকাশ করেন।

এ ছাড়া শোক জানিয়েছেন জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ।

সুত্র :প্রথম আলো